আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু,
(লেখাটি বেশ লম্বা হলেও, সবাইকে অনুরোধ করা হচ্ছে পড়ার ও ভেবে দেখার জন্য)
প্রিয় ভাইয়েরা, যখন আমরা কিয়ামতের দিন সম্পর্কে চিন্তা করি, তখন আমাদের মনে সবচেয়ে বেশি যা কষ্ট দেয়, তা হল আমরা আমাদের পরিবারের সদস্যদের এবং প্রিয়জনদের চিনতে পারব না। বাবা-মা তাদের সন্তানদের ছেড়ে দেবে, স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে চিনতে পারবে না, এবং ভাই-বোন একে অপরকে আর চিনতে পারবে না। সংক্ষেপে, মানুষ নিজেকে নিয়ে তীব্র চিন্তায় চিন্তিত থাকবে। আমরা সবাই বলব, “ইয়া নফসি, ইয়া নফসি!” যদি আমরা এক মুহূর্তের জন্য পরিস্থিতিটি বিবেচনা করি, তাহলে আমরা এমন একটি পর্যায় অতিক্রম করছি, অবশ্যই কিয়ামতের দিনের তীব্রতার চেয়ে বেশি নয়। কোভিড-19 মহামারীর সময় আমরা আমাদের পরিবারের সদস্য এবং প্রিয়জনদের থেকে দূরে সরে গিয়েছিলাম। আমরা সবাই বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ আমাদেরকে এই সংকট থেকে বের করে এনেছেন। আল্লাহ আমাদেরকে কিছুটা স্বাদ দিয়েছেন যে আমরা ভবিষ্যতে কী ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারি। হাশরের ময়দানে আমরাও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ব। এটি মাথায় থাকলে, আমরা কীভাবে আল্লাহর ﷻ আদেশকে অমান্য করে নিষিদ্ধ কাজে লিপ্ত থাকতে পারি? আমরা নিচে এই ধরনের বিষয়গুলির উপর কিছু আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি।
১. যে কোন অশ্লীল কাজে লিপ্ত হওয়া মানুষের সময় নষ্ট করে।
আল্লাহ কুরআনে বিভিন্ন জায়গায় সময়ের শপথ করেছেন। (সূরা আসর, সূরা ফজর, সূরা লাইল ইত্যাদি)
নবী ﷺ হাদিসে বলেছেন, ” এমন দু’টি নিয়ামত আছে, যে দু’টোতে অধিকাংশ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। তা হচ্ছে, সুস্থতা আর অবসর। (সহীহুল বুখারী)
২. ইসলামে গান-বাজনা স্পষ্টভাবে হারাম এবং এটি শুনলে ইবাদতের স্বাদ নষ্ট হয়।
নবী ﷺ হাদিসে বলেছেন, “আমার উম্মাতের মধ্যে অবশ্যই এমন কতগুলো দলের সৃষ্টি হবে, যারা ব্যভিচার, রেশমী কাপড়, মদ ও বাদ্যযন্ত্রকে হালাল জ্ঞান করবে”। (সহীহুল বুখারী) অর্থাৎ, বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হারাম কাজ।
৩. ইসলামে পুরুষ ও মহিলাদের অবাধ মেলামেশা হারাম।
নবী ﷺ পুরুষদের বলেছেন, “মহিলাদের নিকট একাকী যাওয়া থেকে বিরত থাক”। (সহীহুল বুখারী)
অন্য একটি হাদিসে বলা হয়েছে, “নিশ্চয়ই, আপনার জন্য এটি আরও ভালো যে, আপনি কারো মাথায় লোহার পেরেক ঢুকিয়ে দেন, তার চেয়েও ভালো যে, আপনি এমন নারীর স্পর্শ করেন যিনি আপনার জন্য হালাল নন”। (তবারানী: ২০/২১২)
৪. মানুষ এই ধরনের নিষিদ্ধ কাজে প্রচুর টাকা অপচয় করে।
হাশরের ময়দানে মানুষের কাছে জিজ্ঞাসা করা হবে: “কোথা হতে তার ধন-সম্পদ উপার্জন করেছে ও কোন কোন খাতে ব্যয় করেছে এবং কি কি কাজে তার শরীর বিনাশ করেছে।” (সুনান আত-তিরমিজি) সরাসরি হারাম কাজে অংশগ্রহণ করা স্পষ্টভাবে হারাম। এছাড়াও, শারীরিকভাবে অংশ না নিয়ে টাকা দেওয়াও হারাম।
৫. মদ্যপানের উপর ইসলামে কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
নবী ﷺ বলেছেন, “সব নেশাদার দ্রব্য মদ আর সব ধরনের মদ হারাম”। (মুসলিম)
নবী ﷺ আরও বলেছেন, “শরাব পান করো না, কারণ তা সমস্ত পাপাচারের প্রসূতি”। (ইবনে মাজাহ)
আমাদের জন্য আরেকটা ফিতনা হলো, “সিস্টেমে ঢুকে সিস্টেম চেঞ্জ করা”র ফিতনা। সহজ করে বললে, কোনো হারামের part হয়ে কিছু হারাম minimize করার চেষ্টা করা।
আমাদের এডুকেশনাল সিস্টেমের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, “ফ্রি মিক্সিং ও ব্রিটিশ কলোনিয়াল মাইন্ডসেট”। এখানে পুরো সিস্টেমটাই হারাম। তাই পড়াশুনার জন্য বাধ্য হয়ে এই সিস্টেমের part হলেও দ্বীন-ঈমান নিয়ে বেঁচে থাকতে হলে academic এর বাহিরে সব ধরনের প্রোগ্রাম থেকে দূরে থাকতে হবে। এখানে শয়তান বিভিন্নভাবে ধোঁকা দিতে থাকে। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় ধোঁকা হলো, ‘প্রোগ্রামের হারাম অংশ থেকে দূরে থাকলেই তো হয়। তুই গেলে তোর influence এ at least হারামের পরিমাণ অনেক কমে যাবে’। এ বিষয়ে কয়েকটা পয়েন্ট উল্লেখ করছিঃ
১. কোনো পুরো প্রোগ্রামের যে কোনো একটা পার্টে হারাম থাকলে, পুরো প্রোগ্রামটাই হারাম হয়ে যায়। তাই এখানে ‘আমার টাকা হারাম অংশে খরচ হবেনা’, ‘হারাম প্রোগ্রামের সময় অন্য কোথাও থাকব’, ‘আমি অংশগ্রহণ করবো না’ এসব কোনো যুক্তিই গ্রহণযোগ্য না। বরং পুরো প্রোগ্রামটাই হারাম হবার কারণে এখানে টাকা বা নিজে অংশগ্রহণ করাটাও হারাম। ফাতওয়া লিংক
২. আমি হারামে যুক্ত হলে হয়তো কয়েকটা হারাম minimized হবে কিন্তু আমি নিজেই তো এখানে হারামে যুক্ত হয়ে যাচ্ছি। যেখানে মুসলিম হিসেবে আমার দায়িত্ব হারাম কাজে সরাসরি বাধা দেয়া, সেখানে আমি একটা হারাম প্রোগ্রামের পার্ট, এরচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় আর কি হতে পারে! সবার আগে নিজের ঈমান বাঁচাতে হবে।
৩. কোনো সিস্টেমে যতো বেশি অংশগ্রহণকারী থাকে তার গ্রহণযোগ্যতা ততো বেড়ে যায়। কোনো দ্বীনি মুসলিম হিসেবে পরিচিত ব্যক্তি যদি কোনো প্রোগ্রামে attend করে তাহলে অন্যান্য মানুষ সেটাকে reference হিসেবে ব্যবহার করে। তাই আমাদের দ্বীনি ভাইরা কোনো প্রোগ্রামে participate করা মানে সেখানে অংশগ্রহণ যে হারাম এটা বেশিরভাগ মানুষের অজানা থেকে যাবে। সমাজে এটাই normalize হয়ে যাবে এবং এই হারাম কাজটা সমাজে accepted একটা প্রোগ্রাম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে।
৪. কোনো প্রোগ্রামের মূল উদ্দেশ্য বুঝলে সেটার বৈধতা সম্ভব কিনা সেটা বোঝা যাবে। IUT এর দুটো প্রোগ্রাম নিয়ে আলোচনা করলে ব্যাপারটা সহজে বুঝে আসবে। একটা গরু পার্টি আরেকটা ফ্রেশার্স। গরু পার্টির মূল উদ্দেশ্য কি? Graduating ব্যাচ IUT এর সকল স্টুডেন্টস, ফ্যাকাল্টিস ও স্টাফদের জন্য একটা ভোজের আয়োজন করবে। এখানে মূল উদ্দেশ্যের সাথে ইসলামের কোনো values contradict করেনা এবং এই কাঠামোটা সরাসরি কোনো হারাম সিস্টেমের অংশ না। তাই এখানে চাইলে সব ধরনের হারামকে minimized করা সম্ভব। কিন্তু ফ্রেশার্সের সময় এর মূল উদ্দেশ্যই থাকে ‘ছেলে মেয়ে একসাথে পরিচিতি ও চিল করা’। সত্তাগতভাবেই এটা ইসলামে হারাম। তাই যতোদিন পর্যন্ত IUT তে ছেলে মেয়ের separation না হচ্ছে অথবা ছেলে ও মেয়েরা আলাদা আলাদাভাবে ফ্রেশার্স না দিচ্ছে ততোদিন পর্যন্ত কখনোই #Halal_Freshers ও হারাম ফ্রেশার্স একত্রিত করা সম্ভব না। হয়তো কিছুক্ষেত্রে হারামের কিছু পার্ট minimize করা যাবে, তবে সিস্টেম পরিবর্তন না করলে কখনোই পুরো ব্যাপারটাকে হালাল বানানো যাবেনা। picnic/tour এর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। যেখানে মিউজিক, ড্যান্স, ফ্রি মিক্সিং ও কালচারাল বিভিন্ন হারাম প্রোগ্রাম সরাসরি এর সাথে যুক্ত সেখানে দুই একটা অংশ বাদ দিলেও এটাকে হালাল বানানো সম্ভব না। কেননা এখানে যারা যায়, তাদের বড় একটা অংশের মূল উদ্দেশ্যই থাকে ছেলে-মেয়ে একসাথে চিল করা। তাই এটাকে হালাল করার একটাই উপায় হতে পারে আর সেটা হলো, ‘যারা এসব ফাহেশা থেকে দূরে থাকতে চায়, তাদের জন্য পুরোপুরি আলাদা একটা location ঠিক করা’। তাই same প্রোগ্রামে গিয়ে আস্তে আস্তে একে হালাল বানানো সত্তাগতভাবেই কখনো সম্ভব না। দ্বীন-ঈমান বাঁচাতে হলে এটা থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করার কোনো alternative নেই।
৫. কোনো হারাম সিস্টেমের পার্ট হয়ে ব্যক্তিগত উন্নতি সম্ভব হতে পারে, কিছুক্ষেত্রে সমাজেরও কিছুটা উন্নতি করা সম্ভব কিন্তু ultimately এর মাধ্যমে একটা হারাম সমাজ ব্যবস্থা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। একইভাবে দ্বীনি মানুষজন ক্যাম্পাসের বিভিন্ন হারাম প্রোগ্রামে এটেন্ড করলে হয়তো সেখানের কিছু হারাম কমে আসবে, তবে এর মাধ্যমে হারাম প্রোগ্রামগুলো ক্যাম্পাসে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। তখন এই হারাম প্রোগ্রামের বিরোধীতা করাটাকেই extrimism বলা হবে। কোনো মুমিন তাকওয়ার কারণে এখানে এটেন্ড না করলে তাকে ভর্ৎসনা ও তিরষ্কার করা হবে। ডেমোক্রেসি, ক্যাপিটালিজম, ন্যাশনালিজমসহ অসংখ্য কুফরি মতবাদগুলো এভাবেই আমাদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই দাওয়াহর জন্য এটাই বেটার যে, যারা এখানে এটেন্ড করবে তারা এটাকে হারাম জেনে শুনেই এটেন্ড করুক এবং আল্লাহ ভীতি থাকলে পুরো হারাম প্রোগ্রাম থেকেই দূরে থাকুক। কম মানুষই হয়তো দূরে থাকতে পারবে, কিন্তু যারা পারবে কুরআনের ভাষায় তারাই সফলকাম।
৬. কোনো ক্যাম্পাসের অবস্থা এতোটাও বাজে না যে, সমাজ বিচ্ছিন্নতা দূর করা, personal relation ও দাওয়াহর জন্য দ্বীনি মানুষদের হারাম প্রোগ্রামে participate করতে হবে। বরং এর জন্য অসংখ্য উপায় আছে। তাই জিনিসটা হারাম হলে একজন মুসলিম কেনো সেখানে এটেন্ড করবে? এটা তার দ্বীনের পবিত্রতা নষ্ট করে দেয় এবং সে এই প্রোগ্রামের একটা পার্ট হিসেবে মানুষকে সর্বোচ্চ কিছু হারাম থেকে দূরে থাকার দাওয়াহ দিতে পারবে, যেটা কখনোই পুরোপুরি ইসলামের দাওয়াহ না।
৭. একজন মুসলিম, যে সবসময় তাকওয়া অবলম্বন করতে চায় ও যতোটুকু পারে হারাম কাজে বাধা দেয়, সে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে এমন কোনো প্রোগ্রামে এটেন্ড করবে যেখানে সে জানে, ‘এই প্রোগ্রামকে কেন্দ্র করে অসংখ্য হারাম ও ফাহেশা কাজ হবে’। এটা জাহেলিয়্যাত ও দৃষ্টিকটু কাজ। বৃষ্টির ফোঁটা থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা ব্যক্তি কখনো পুকুরে নামতে পারেনা।
তাই বিদ্যমান সেসকল প্রোগ্রাম ও পেজগুলোর সাথে আমার বিন্দুমাত্র কোনো সম্পর্ক নেই যেখানে মিউজিক, বেপর্দা ছবি/ভিডিও ও হারাম কন্টেন্ট শেয়ার করা হয়। যতোই ব্যাচ বা ডিপার্টমেন্টের নামে এগুলো থাকুক না কেনো এটা মূলতো কিছু মানুষের দ্বারাই পরিচালিত।
একটা মুসলিম সমাজে ঈমান-কুফর ও হালাল-হারাম একেবারে সুস্পষ্ট ও প্রতিষ্ঠিত থাকতে হবে। এরপর যার ইচ্ছা দ্বীন গ্রহণ করুক আর যার ইচ্ছা নিজের জন্য জাহান্নামের ভয়ঙ্কর আযাব ঠিক করে নিক। আমাদের দায়িত্ব পৌছে দেয়া ও সতর্ক করা, আমি করেছি, আলহামদুলিল্লাহ।
+ There are no comments
Add yours